চাকরি হারিয়ে দুদক কর্মকর্তা শরীফ এখন দোকানি

জীবন তো বাঁচাতে হবে

Passenger Voice    |    ১২:০৪ এএম, ২০২২-১১-০৭


জীবন তো বাঁচাতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক ।।

জীবন তো বাঁচাতে হবে। তাই দোকানে বসেছি। দুর্নীতিবাজদের রোষানলে পড়ে শরীফ উদ্দিন যখন চাকরি হারিয়ে মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন, তখন পরিচিত মুখগুলো ধীরে ধীরে তার কাছ থেকে দুরে সরে যাচ্ছিলেন। তখন সংসার চালানোর তাগিদে তাঁর ভাইয়ের ওমর কফি শপ নামের কনফেকশনারিতে দোকানদারি শুরু করেন

 চাকরি হারিয়ে এক সময়ের দাপুটে এই দুদক কর্মকর্তা সংসার চালানোর জন্য হয়েছেন কনফেকশনারি দোকানি। চট্টগ্রামের ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মেওমর কফি শপনামের দোকানটিতে গত একমাস ধরে নিয়মিত বসেন। নতুন পেশায় যুক্ত হওয়ার পর বেশিরভাগ মানুষ তাকে সাধুবাদ জানালেও শরীফ বলছেন, ‘জীবন তো বাঁচাতে হবে। তাই দোকানে বসেছি।

নতুন পেশা শুরুর পর রোববার ( নভেম্বর) ষোলশহর রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ওমর কফি শপে কথা হয় শরীফ উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এক মাস ধরে দোকানে বসছি। আমাকে অপসারণের পর দুদকসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা আমার স্থায়ী-অস্থায়ী সবগুলো বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান করেছে। অপসারণের পর বেনামি একটি অভিযোগ করা হয়েছে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, আমি নাকি হাজার কোটি টাকার মালিক, আমার ৩৭টি বাড়ি আছে, সিঙ্গাপুরে নাকি ৪টি বাড়ি আছে। এগুলো কই?’

এখন সংসার কীভাবে চলছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জীবনের মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য যা না করলে নয়, তাই করতে হচ্ছে। আগে সরকারি চাকরি করতাম, প্রতি মাসে বেতন আসতো। তাতে সংসার চলতো। এখন কোনো কাজ নেই, সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। পরিবারের খরচ, বাচ্চাদের পড়ালেখার খরচ, মায়ের ওষুধ- কোনোটাই তো বন্ধ নেই। অপসারণের পর ছোটখাটো হলেও একটি চাকরি নিতে অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছে গিয়েছি, যাতে আমার পরিবারের খরচটা চালাতে পারি। কিন্তু দুদকের ভয়ে কেউ চাকরি দিতে চায় না। কিছু একটা তো করতে হবে, জীবন তো বাঁচাতে হবে। তাই দোকানে বসেছি।

পরোক্ষভাবে অনেক হুমকি পাওয়ার কথাও জানান দুদকের এই আলোচিত কর্মকর্তা। যখন তার সঙ্গে কথা হয় তখন তিনি দোকানের ক্যাশ সামলাচ্ছিলেন। ক্রেতাদের জিনিসপত্র দিচ্ছিলেন, আর দাম নিয়ে ক্যাশবাক্সে রাখছিলেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি বলেন, ‘আমাকে রাস্তার ফকির বানাবে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরাবে। দেশান্তরি করবে-এমন হুমকি দেওয়া হচ্ছিল অনেক দিন থেকে।

দুর্নীতিবাজ চক্রগুলো আমার বিরুদ্ধে এখনো বেনামি চিঠি দিয়ে যাচ্ছে। আমি নাকি ইয়াবাখোর, গাঁজাখোর। আমি জীবনে কখনো সিগারেট খাইনি। হাতও দেইনি। এই দোকানে বসে ক্রেতাদের দেওয়ার জন্য হাতে সিগারেট ধরেছি। তাও কাস্টমারদের দেওয়ার জন্য। আমি একজন ভেটেরিনারি চিকিৎসক। ধূমপান ক্ষতিকর, সেটা আমার জানা আছে।যোগ করেন তিনি।

নতুন জায়গায় কাজ শুরুর অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি খ্যাতির বিড়ম্বনার কথা জানান। বলেন, ‘দেশের মানুষ আমাকে ভালোবাসেন, সেই ভালোবাসার কারণে আমি এখনো টিকে আছি। চাকরি হারানোর পর এই মাসে আমার প্রতি গণমাধ্যমের যে ভালোবাসা, তাতে আমি অভিভূত। সাধারণ মানুষের অভিব্যক্তি সম্পর্কে শরীফ বলেন, ‘যারাই আমাকে চেনেন, তারা আমাকে এখন অভিনন্দন জানাচ্ছেন। বলছেন, আপনি হালাল ব্যবসা করছেন। অনেকে দেশের টাকা চুরি করে বিদেশে পাচার করে। আপনি সেই পথে না গিয়ে হালাল একটি ব্যবসা করছেন। এটাই সবার জন্য শিক্ষা হওয়া উচিত।

পরিবারের সাপোর্ট পাচ্ছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি ভেটেরিনারি ডাক্তার ছিলাম। আমি চাইলেই তো আগের মতো চলতে পারবো না। আমার ফ্যামিলি আমার দিকটা বিবেচনা করে। বাচ্চাদের আমি মুখ দেখাতে পারি না। আগে বিভিন্ন অনুসন্ধান নিয়ে রাতের পর রাত কক্সবাজারে থাকতাম। এখন বাসায় বসে থাকি। এখন সন্তানরা প্রশ্ন করে, বাবা তুমি এখন কক্সবাজার যাও না? যখন কয়েকজন লোক আমার বাসায় এসে আমাকে হুমকি দিয়ে গেলো, বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর আবার বাচ্চা আমাকে জিজ্ঞেস করে, বাবা তোমাকে মারতে আসছে কেন? তুমি কাঁদো কেন? আসলে এগুলোর কোনো উত্তর নেই।

এখনো কেন এমন হুমকি? এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি যে কাজগুলো করেছি, তার মধ্যে আলোচিত ৫টি ইস্যু নিয়ে প্রভাবশালীরা আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপেছেন। প্রথমত, কক্সবাজারে সরকারি প্রকল্পে লাখ লাখ কোটি টাকার জমি অধিগ্রহণ প্রকল্পে যে সুবিধাভোগী চক্র রয়েছে, যারা আমার কারণে অনেকটা কোণঠাসা হয়েছিলেন, তারাই আমার বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী। দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গাদের এনআইডি, পাসপোর্ট পাওয়া এবং দেওয়ার পেছনে যে চক্রটি জড়িত তারাও আমার ওপর ক্ষেপেছে। তৃতীয়ত, পেট্রোবাংলার কর্ণফুলী গ্যাসে (কেজিডিসিএল) অনেক অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমি মামলার সুপারিশ করেছিলাম, মামলাও করেছিলাম, তারাও আমার ওপর ক্ষিপ্ত। চতুর্থত, চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যখাতের একটি ফাইল নিয়ে আমি কাজ করেছিলাম। তাছাড়া ফটিকছড়ির প্রভাবশালী চেয়ারম্যান জানে আলমের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করেছিলাম, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের অনিয়ম নিয়ে মামলার সুপারিশ করেছিলাম। আসলে সবগুলো চক্রের লোকজন এক হয়ে গেছে আমার বিরুদ্ধে।

মো. শরীফ উদ্দিন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চাকরিচ্যুত উপ-সহকারী পরিচালক। বলা চলে, কয়দিন আগেওদুদকের শরীফবলে বাচ্চাদের কান্না থামানো হতো। ঘুম পড়ানো হতো কান্নারত বাচ্চাদের। যার নাম শুনে অনেক দুর্নীতিবাজ দুর্নীতি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। সরকারি আমলা থেকে শুরু করে বড় বড় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, সিআইপি, আইনজীবী,